পিঠ রগড়ে থাবা মেরে শুধু একবার বলতে হত, "যাহ্ বাহাদুর!" চি হিঁ হিঁ শব্দে বাহাদুর পুকুর ঘাট থেকে টগবগিয়ে ছুটতে ছুটতে সোজা বাড়ি ফিরে আসতো - ছুটন্ত চিতাবাঘের মতো তার গতি; ফুটন্ত খইয়ের মত তার ছন্দ। তার দিকে কিছুক্ষণ বুক ফুলিয়ে তাকিয়ে থেকে কালুও পুকুরে ঝুপ করে দুটো ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরত।
গাড়ির সঙ্গে একবার শুধু তাকে জুড়ে দিতে হতো; সামনে অন্য কোন গাড়ি থাকলে একবার শুধু বলতে হতো - "লে বাহাদুর!" তল্লাটে এমন কোন ঘোড়ার সাধ্যি ছিল না বাহাদুরের আগে আগে চলতে পারে। পেছনে তাকে আসতে দেখেই প্রত্যেকে সাইড দিতে বাধ্য হত।
প্রায় ষোল বছর পূর্বে কালু যেদিন বিয়ে করে তার ঠিক পাঁচ দিন পরেই শ্বশুরের দেওয়া যৌতুকের টাকায় সে বাহাদুরকে কিনে আনে। বাহাদুরের বয়স তখন খুবই অল্প। নিজের হাতে যত্ন নিয়ে সে তাকে 'মানুষ' করেছিল - রূপান্তরিত করেছিল এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ ঘোড়ায়। বাহাদুরের বাহাদুরিতে আজ তার দুখানা ঘরের মাটির দেওয়াল ইটের দেওয়ালে পরিণত হয়েছে।
আজ ষোল বছর পর বাহাদুর দাঁড়িয়ে আছে তার চির পরিচিত, একান্ত আপন, পৃথিবীতে তার একমাত্র সঙ্গী, অন্নদাতা মালিক কালু শেখের বাড়ির রাস্তার ধারে। ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে আছে বাড়ির দিকে। বুকের বাতাগুলি যেন উদ্ধত তলোয়ারের মতো বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে - সামনের একটি পা ধনুকের মতো বেঁকে গেছে, বাকি নড়বড়ে তিনটি পা এই জরাজীর্ণ শরীর টিকে একটু সোজা করে ধরে রাখার জন্য সমানে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
ঘোলাটে চোখ দুটো দিয়ে বাহাদুর দেখতে পেল, কালু শেখ একটি নতুন, অল্প বয়সী ঘোড়ার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে তার থাকার জন্য নির্দিষ্ট করা উঠানে শূন্য পাত্রের পাশে বেঁধে দিল। অবাক বিস্ময়ে বাহাদুর দেখতে থাকলো পাত্রটি ধীরে ধীরে ছোলা, গুড়, ভুষিতে পূর্ণ হয়ে উঠল। অথচ এর আগে প্রায় মাস খানেক থেকে পাত্রটিতে ছোলা-গুড় তো দূরের কথা এক ফোঁটা জলও পড়েনি।
ক্ষুধার্ত বাহাদুরের আর সহ্য হলো না - ধীরে ধীরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রাণপণে এগিয়ে চলল তার বাসস্থানের দিকে। কিন্তু একি! তার মালিক রৈ রৈ করে তার দিকে তেড়ে আসছে কেন? কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিঠের উপর পড়ে গেল লাঠির এক ঘা। আর্তনাদ করার ক্ষমতা তার নেই। বিষম্ যন্ত্রণায় মনিবের চোখের দিকে একবার সে তাকালো; দেখল ওই চোখ দুটিতে তার জন্য আর কোন মায়া অথবা ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। মনিবের কাছে সে একটা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এইতো কয়েকদিন আগেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বহু দূরের সেই ফাঁকা মাঠে। সেখানে যখন কালু তাকে ছেড়ে এসেছিল, ও ভেবেছিল মালিক হয়তো আবার এসে তাকে নিয়ে যাবে, কিংবা হয়তো তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। বাড়ির তীব্র আকর্ষণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বহু কষ্টে আজ সে ফিরে এসেছে। কিন্তু হায়! প্রবল আকর্ষণ আর তীব্র ভালোবাসার কোন মূল্যই আজ আর এখানে নেই। যার জন্য শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু সে খরচ করল সে-ই আজ যমজুদের মত সামনে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে। ফ-র-র-র-র শব্দে নাক দিয়ে শুধু একটা নিঃশ্বাস বেরোল - তারপর রুগ্ন পশুটি মুখ ফিরিয়ে উল্টোদিকে চলতে শুরু করল। ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে আবার থমকে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে দেখল, সেই নবাগত নতুন অতিথি মহানন্দে ভোজ খাচ্ছে। আজ থেকে ঐ এক চালা ঘরটি তারই অধিকারে চলে গেল। ঐ খাদ্যের গামলায় মুখ দেওয়ার কোন অধিকার আর এই প্রাচীন বৃদ্ধের থাকলো। না না না মহা ভুল, মস্ত বড় ভুল, তা কেন হবে! ঐ তো কালু শেখ এগিয়ে আসছে। হাতে তার কোন লাঠি নেই। তার বদলে আছে একটা ছোট দড়ি। এর অর্থ সে বোঝে। এক্ষুনি মনিব তাকে নিয়ে গিয়ে গামলার পাশে বেঁধে দেবে। আহ্ কি আনন্দ! বহুদিন পর আবার সে ছোলা-গুড় দিয়ে পেটপুরে খাবার খাবে। তীব্র আবেগে সে কালুর দিকে এগিয়ে যেতে চাইলো - মুখ তুলে তার গা শুঁকতে গেল। কালু তার হাতের দড়িটা তার গলায় বেঁধে দিল। নাহ্,আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয় - গলা বাড়িয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওই শত্রুটার কাছ থেকে তার খাদ্যের গামলাটি কেড়ে নেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু এ কি! কালু তাকে উল্টোদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেন? তীব্র অভিমানে তার গতি শ্লথ হয়ে গেল। বারবার ঘুরে ঘুরে তাকাতে লাগলো খাদ্যের গামলার দিকে। কালু তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল রাস্তার ধারের আম বাগানের দিকে; এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ঘাস জন্মেছে। এর মাঝখানে কালু তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।
মাঠে-ময়দানে, বাগানে-জমিতে ঘাস পাতা খেয়ে কোনরকমে তার চলে যাচ্ছিল। শরীর আগের থেকে আরও দুর্বল হয়ে গেছে। চলার শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। বাঁশ বাগানের ডোবার ধারে এসে শেষবারের মতো সে লুটিয়ে পড়ল। ক্ষুধার তাড়নায় আশ-পাশের মৃতপ্রায় ঘাস আর শুকনো পাতা চিবোতে শুরু করল - ধীরে ধীরে সেগুলোও নিঃশেষ হয়ে গেল। গলা বাড়িয়ে জিভ দিয়ে দূরের ঘাস পাতা টেনে খাওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। একসময় দেখা গেল তার চারপাশের মাটির বৃত্তাকার অংশ ঘাস পাতা শূন্য হয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে গেছে।
ওই তো সামান্য একটু দূরে গাছের ছোট্ট একটা ডাল ভেঙে পড়েছে। আগুনের লেলিহান শিখার মত প্রসারিত হয়েও সর্বগ্রাসী জিহ্বা ডালের পাতাগুলির কোন নাগাল পেল না। তার সমস্ত শক্তি নিংড়ে সেই দিকে আর একটু গড়িয়ে যেতে চাইলো - কিন্তু ডোবার একেবারে কিনারায় এসে সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না - গড়িয়ে পড়ে গেল ডোবার মধ্যে। সেখানে কোন জল ছিল না। ছিল কুচকুচে কালো কাদার পাঁক। এই ডোবার মধ্যে তার সমস্ত শরীরটাই যেন পাঁকের সাথে মিশে গেল। মুখ তুলে সে একবার উঠে যেতে চাইল, কিন্তু পারল না - নেতিয়ে পড়ল।
এই মৃত্যুফাঁদ থেকে কোন মানুষ কি তাকে উদ্ধার করবে? ওই তো তিনটি ছোট ছোট ছেলে - মানুষের বাচ্চা - কৌতুহলী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। আশায় বুক বেঁধে আর একবার সে মাথা তুলে ওঠার চেষ্টা করল। নাক দিয়ে শুধু একবার ফ-র-র-র শব্দ বেরোল। হয়তো মানুষের কাছে সে মিনতি জানিয়ে আবেদন করল "আমাকে বাঁচাও"। কিন্তু কোন মানব সন্তান তার ভাষা বুঝলো না; সেখান থেকে তারা চলে গেল।
ধীরে ধীরে তার কাছে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এলো, পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল যেন শান্ত হতে শুরু করল। জীবনের সমস্ত আশা পরিত্যাগ করে সে চোখ দুটি বন্ধ করে নিল। এমন সময় হঠাৎ তার সমস্ত অন্তরাত্মাকে আলোড়িত করে তার কানে একটি শব্দ পৌঁছালো - এই শব্দ তার চির পরিচিত, হৃদয়ের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক। তার সমস্ত শরীরটা একবার তোলপাড় করে উঠলো; চোখ খুলে গলা বাড়িয়ে চতুর্দিকে কাকে যেন খুঁজতে লাগলো। আবার শব্দ এল - "ধর্ ধর্ ধর্ ধর্ - চল পাগলি!"
রাস্তা দিয়ে তখন কালু সেখ প্যাসেঞ্জার তুলে তার নতুন 'পাগলি'কে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে শব্দ মিলিয়ে গেল। বাহাদুরের মুখটি আবার কাদার সঙ্গে মিশে গেল।
সমাপ্ত