শাস্তি | গল্প | Bangla golpo | Choto golpo

 

শাস্তি  |  গল্প  |  Bangla golpo  |  Choto golpo

"এই সাইকেল দুটো কার?"

প্রার্থনার জন্য লাইন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জিএম স্যার ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন।

" কি হলো, কেউ উত্তর দিচ্ছ না কেন? আমি জানতে চাই সাইকেল দুটো কে এখানে রেখেছে?" 

 কিন্তু নিশ্চুপ ছাত্রদের কাছ থেকে কোন উত্তরই এলোনা। সমগ্র স্কুলের কোলাহল মুখর ছাত্রের দল একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে রইল।

যে সাইকেল দুটোর জন্য শিক্ষক মশাই মুহুর্মুহু হুংকার ছাড়ছেন, তারা স্কুলের প্রবেশপথের দেয়ালে ঠেস দিয়ে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এদের মালিক দুটি এই পড়ুয়াদের দলের মধ্যেই হয়তো কোথাও চোরের মত সংকুচিত হয়ে প্রাণপণে নিজেদের লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

"কে এখানে সাইকেল রেখেছে তা না বললে, আমি কিন্তু নিজেই তাদের ধরতে বাধ্য হব; আর এরপর শাস্তি হবে ভয়ানক।"

এতক্ষণে লাইনের মধ্য থেকে একটি শঙ্কিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল - "আমার সাইকেল স্যার।"

"এইদিকে এগিয়ে আয়।"

ছেলেটি ধীরে ধীরে পাংশু মুখে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

"নিষেধ করা সত্ত্বেও তুই এখানে সাইকেল রেখেছিস কেন?"

"আমি জানতাম না স্যার।"

"স্কুলের এতগুলো ছেলে মেয়ে জানে আর তুই জানতিস না! কালকেও বলে দেওয়া হয়েছে, যেন এখানে কেউ সাইকেল না রাখে।"

এই মাধ্যমিক স্কুলটিতে প্রবেশ করার জন্য তিন, চারটি উন্মুক্ত পথ রয়েছে। এর মধ্যে যে পথটি স্কুল বিল্ডিং এর নিচু তলা দিয়ে গেছে সেটি অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এই গলিটির দেওয়ালে  অনেক সময় নিজেদের সাইকেলগুলো ঠেস দিয়ে রাখত। এতে সাইকেলের আধিপত্যে স্কুল যাত্রীরা যাতায়াতের অবাধ স্বাধীনতা কিছুটা বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রুদ্ধ হেড স্যার প্রায় একমাস পূর্বে এক আইন জারি করে এই গলির বুক থেকে সাইকেলের সাম্রাজ্য ধ্বংস করেন।

কিন্তু পুনরায় ধীরে ধীরে সাইকেলগুলো তাদের পুরাতন রাজত্বে ফিরে আসে। গতকাল পুনরায় এই গলিতে সাইকেল রাখতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কাল শুভঙ্কর স্কুলে না আসায় নিষেধ বাক্যটি তার কানে পৌঁছায়নি। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে আজ সে অপরাধীর কাঠগড়ায় স্যারের সামনে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে।

দ্বিতীয় অপরাধী ছাত্রটিও স্যারের সামনে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটি জগা নামে প্রসিদ্ধ। সে ক্লাস সিক্সে পড়ে। এতোটুকু বয়সেই সে দিনে দশ-বারোটি বিড়ির ধোঁয়া অনায়াসে ফুসফুসে চালান দিতে সক্ষম। সুতরাং লজ্জা জিনিসটাকেও সে বহুদিন পূর্বেই গলাধঃকরণ করে ফেলেছে।

"পাঁচবার কান ধরে ওঠ্-বস্ কর।"

হুকুম পাওয়া মাত্রই জগা অতি দ্রুত সাতবার কান ধরে উঠাবসা করে দাঁড়ালো এবং তার এক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে মুচকি একটু হাসলো। এ যেন তার কাছে পরম তৃপ্তির বিষয় - এতগুলো ছাত্রছাত্রীকে তামাশা দেখানোর সুযোগ পেয়ে সে যেন ধন্য হয়ে গেছে। স্যার তাকে লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে বললে সে বিজয়ের গর্ব নিয়ে স্ব-স্থান অধিকার করল।

শুভঙ্করকে একভাবে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিএম স্যার গর্জন করে উঠলেন,  "কি হলো, তুই শুনতে পাচ্ছিস না? পাঁচবার কান ধরে ওঠাবসা কর!"

কিন্তু শুভঙ্কর এতোটুকুও নড়লো না। স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এই ছেলেটি দশম শ্রেণীর ছাত্র। অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির এবং মুখচোরা বলে সে সাধ্যমত সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে চলতেই বেশি পছন্দ করত। আজ হঠাৎ স্কুলের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে লাঞ্ছিত হয়ে সে লজ্জায় একেবারে মাটির সাথে মিশে যেতে চাইলো।

শিক্ষক মশাই আবারো হুংকার ছাড়লেন। কিন্তু কোন কথা-ই তাকে বিচলিত করতে পারল না। সমস্ত কিছুই যেন তার কাছে স্বপ্নের মত আবছা হয়ে এলো।

এবার হেড স্যার দোতলার অফিস ঘরের সামনে থেকে চিৎকার করে উঠলেন,  "মারেন, মারেন। ওভাবে হবে না, মারতে হবে।"

জিএম স্যার শুভঙ্করের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন,  "লাঠিটা নিয়ে আসুন তো!"

শুভঙ্কর আচ্ছন্নের মতো দুই হাত দিয়ে তার কানদুটো ধরে বলল,  "ভুল হয়ে গেছে স্যার; আর কোনদিন এ কাজ করব না। দয়া করে ক্ষমা করে দিন স্যার।"

"ক্ষমা ! কিসের ক্ষমা ! কোন ক্ষমা নেই। তোকে কান ধরে ওঠাবসা করতেই হবে।"

এই শিক্ষকদের মধ্যে ইংলিশ স্যার শুভঙ্কর কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। স্বভাব চরিত্র এবং পড়াশোনার জন্য শুভঙ্কর তার প্রিয় পাত্র ছিল। তিনি শুভঙ্করের অত্যন্ত কাছে এসে তার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, "পাগল ছেলে! স্যারের কথা শুনতে হয় ; তিনি যেটা বলছেন সেটা কর; নইলে মার খেতে হবে।"

এবার শুভঙ্কর কান ধরে ওঠাবসা করে দাঁড়ালো। কিন্তু সমস্ত পৃথিবীটাই যেন তার কাছে অন্ধকার হয়ে এলো। পৃথিবীর সমস্ত দৃশ্যই যেন তার চক্ষুর অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল। সামনের এতগুলো ছাত্র-ছাত্রী ধীরে ধীরে যেন তার কাছে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলল। সে টলতে টলতে কোনমতে নিজের লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। এর মধ্যেই যে কখন দেশমাতৃকার জয় গান সম্মিলিত কন্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে সমাপ্ত হয়ে গেল এবং কখন যে সে ক্লাসরুমে প্রবেশ করে নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসেছে কিছুই সে বুঝতে পারল না।

বন্ধুবান্ধবরা তার দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালে এবং তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলে সে ভেঙে পড়ল। রুদ্ধ অশ্রুধারা তার গতিপথের সমস্ত দুয়ার চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে প্রবল গতিতে তার চোখ দুটি দিয়ে প্রবাহিত হতে লাগলো। প্রথম ক্লাসটি সে হাই বেঞ্চে হাত রেখে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কাটিয়ে দিল। তারপর অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে ধীরে ধীরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে সে বাড়ি চলে গেল।

চুপিসারে নিজের ঘরে গিয়ে শুভঙ্কর দরজা বন্ধ করে দিল - চাদর মুড়ি দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল। এক সর্বগ্রাসী অগ্নিশিখা যেন তার যন্ত্রণা-কাতর হৃদয়কে মুহুর্মুহু জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিতে লাগলো। আর সেই জ্বলন্ত হৃদয়ের উত্তাপে তার দুই চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় বাষ্প নির্গত হয়ে উপাধান সিক্ত করে তুলল।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তার কান্না থেমে গেল ; ধীরে ধীরে উঠে সে বিছানায় বসলো। তার আরক্ত চোখ দুটি থেকে ধীরে ধীরে অশ্রু-চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। এক নিষ্ঠুর হিংস্রতা তার চোখ দুটিকে কঠোর করে তুলল। অতি শান্তভাবে সে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল এবং একটি ছোট চিরকুটে কয়েকটি বাক্য লিখে পকেটে পুরে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দোকান থেকে তরল পদার্থ পূর্ণ একটা ছোট্ট শিশি কিনে বাড়ি ফিরে দেখল, তার চার বছর বয়সী ছোট বোন শম্পা তার ঘরে খেলতে গিয়ে এলার্ম ঘড়িটাকে ভেঙ্গে বসে আছে। দাদাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো, "আমি ভাঙিনি দাদা। খাতাটা নিতে গিয়েছিলাম; ঘড়িটা আপনি-ই পড়ে ভেঙে গেল।"

জবাবে শুভঙ্কর শুধু একটু মুচকি হেসে তাকে কোলে নিয়ে বলল,  "ভেঙেছে তো কি হয়েছে? ও আবার কেনা যাবে। এই দেখ, তোর জন্য আমি কত জিনিস গুছিয়ে রেখেছি ; আজ আমি তোকে সমস্ত কিছুই দিয়ে দেব। এগুলো যত্ন করে রাখিস - কেমন?"

শুভঙ্কর আলমারি থেকে তার সমস্ত  ছোট ছোট সৌখিন জিনিসগুলো বের করে শম্পার হাতে দিয়ে দিল। একটা দামি খেলনা এরোপ্লেন সে কিনে রেখেছিল ; সেটাও তার ছোট বোনের দখলে চলে গেল। অথচ এতদিন এই দস্যি মেয়েটির প্রকোপ থেকে এগুলোকে রক্ষা করার জন্য কতই না কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল। আজ হঠাৎ অযাচিতভাবে এগুলোকে নিজের অধিকারে পেয়ে বালিকাটি আনন্দে একেবারে আত্মহারা হয়ে উঠল । শুভঙ্কর নির্নিমেষ চোখে এই আনন্দমুখর বালিকাটির দিকে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ তাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে সে অবোধ বালকের মতো ডুকরে কেঁদে উঠলো। শম্পা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "তুই কাঁদছিস কেন রে দাদা?"

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শুভঙ্কর কোন উত্তর দিতে পারল না। কিছুক্ষণ পর সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "কোথায় কাঁদছি রে? আমি তো তোর কথা ভাবছি। তুই একদিন কত বড় হবি ; কত সুন্দর হবি ; তখন আমাকে তুই ভুলে যাবি নে তো! বল্ - চিরজীবন আমার কথা মনে রাখবি ? কোনদিন ভুলে যাবিনে!"  উচ্ছ্বসিত আবেগে আবার সে কেঁদে ফেলল।

 কিন্তু এ কান্না অতি শীঘ্রই নিস্তেজ হয়ে গেল। আবার তার মুখে সেই হিংস্রতা ফুটে উঠলো। শম্পাকে ছেড়ে দিয়ে সে বলল,  "তুই খেলনা গুলো এখন মাকে দেখাবি নে ; বুঝলি? আজকে এই ঘরে লুকিয়ে রেখে কালকে বের করবি - কেমন?"

শম্পাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে সে তার পূর্ব লিখিত চিরকুটটি পকেট থেকে বের করে ছিঁড়ে ফেলল এবং একটি নতুন চিরকুট লিখে পুনরায় পকেটে পুরে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বাড়ির পেছন দিকের বিস্তীর্ণ জমিতে পাট বোনা রয়েছে এবং পাট গাছগুলো ছয়-সাত হাত উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে সগর্বে তাদের যৌবনকাল ঘোষণা করছে। শুভঙ্কর পাট ক্ষেতের কিনারায় এসে থমকে দাঁড়ালো এবং বাড়ির দিকে ফিরে তাকালো। এক দৃষ্টিতে সে তার বাড়ির দিকে চেয়ে রইল। এই চির পরিচিত গৃহটির প্রতিটি অংশ আজ হঠাৎ যেন এক নতুন রূপ ধারণ করে তার সামনে আবির্ভূত হল। এর আগে কতদিন সে এখান থেকে বাড়িটিকে দেখেছে ; কিন্তু কোনদিন সেটিকে তার এত আপন বলে মনে হয়নি। এই গৃহটির প্রতিটি ইটের সঙ্গে যেন তার জন্ম-জন্মান্তরের সমন্ধ রয়েছে - আর আজ হঠাৎ এদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে এদের ভালোবাসার তীব্র আকর্ষণ যেন তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো।

আজ সকালে শম্পা তার ক্লাসের একটি বই হাতে নিয়ে শুভঙ্করের কাছে এসে বলেছিল,  "দাদা, আমায় পড়াবি না?" শুভঙ্কর বলেছিল, "এখন না,  কালকে পড়াবো।"

হঠাৎ তার স্নেহের ছোট বোনের সেই কণ্ঠস্বর তার হৃদয়ের মাঝে শত কন্ঠে ধ্বনিত হয়ে তাকে অস্থির করে তুলল। তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে সে বাড়ির দিকে কয়েক পা এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালো। পৃথিবীটা আবার তার কাছে বিষাক্ত বলে মনে হলো। এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার জন্য কোথাও সামান্যতম স্থান-ও সে খুঁজে পেল না। তার ঠোঁট দুটো শক্ত হয়ে বার কয়েক কেঁপে উঠল এবং অতি দ্রুত সে পাটের জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিকেলে শুভংকরের বন্ধুদের কাছে স্কুলের ঘটনা শুনে তার বাবা-মা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠলেন এবং তাদের এই চির অভিমানি পুত্রটির সন্ধান করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও তার দেখা পাওয়া গেল না। আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে খোঁজ নিয়েও কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। এভাবে অস্থিরতা নিয়ে একটি রাত কেটে গেল। পরদিন সকালে একটি ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে সংবাদ দিল যে, শুভঙ্কর মাঠের মধ্যে পাটের জমিতে পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে গাল দুটি ভিজে গেছে এবং পাশে একটি বিষের শিশি পড়ে আছে। তার পকেট থেকে একটি চিরকুট পাওয়া গেল, যাতে লেখা আছে, "স্কুলের অপমান সহ্য করতে না পেরে আমি আত্মহত্যা করলাম।"

তার গায়ে হাত দিয়ে দেখা গেল, সমস্ত শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।...... এই ধরণীর সমস্ত মান অপমানের দ্বন্দ্ব থেকে সে চিরজীবনের মতো অবসর নিয়ে অন্তহীন জীবনের পথে যাত্রা করেছে।


                                     সমাপ্ত 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.