"আমি বলেছিলাম না মা, আমাকে টপকে ফার্স্ট হবার ক্ষমতা স্কুলে কারও নেই। এই দেখো তোমার ছেলে গতবারের থেকেও কত ভালো রেজাল্ট করেছে; তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছিলে। যেদিন তোমার ছেলে ডাক্তার হয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে সেদিন দেখবে তোমার সব দুশ্চিন্তা কোথায় হারিয়ে গেছে।" অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র বরাবরের ফার্স্ট বয় সোহেল তার কর্মরত মাকে পেছন দিক থেকে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে ধরল। মা সোহেলের কাছ থেকে মার্কশিট টা নিতে নিতে মুচকি হেসে শুধু বললেন "পাগল ছেলে!"
(২)
২০০০ সালে বাংলার মাটি ভয়াবহ প্লাবনে ভেসে গেল। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম পদক্ষেপ যেন বঙ্গভূমির দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত আবর্জনা এক নিমিষে পরিষ্কার করে নিয়ে গেল। গ্রাম বাংলার মাটির বাড়িগুলিকে মৃত্তিকা দেবী আপন দেহে বিলীন করে নিলেন। শস্যময় সবুজ প্রান্তর প্লাবন-দৈত্য উদরস্থ করে ফেলল। অবশেষে শস্য গুলিকে হজম করে তার বর্জ্য গুলি মাঠে ময়দানে নিক্ষেপ করে সে পলায়ন করল।
বন্যা বিধ্বস্ত গ্রাম দৌলতপুর। গ্রামের প্রান্তে একটি বাড়ির মাটির দেয়াল গুলি নিহত সৈনিকের লাশের মত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। একটি মাত্র ইটের তৈরি ঘর কোনরকমে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এই ঘরের বারান্দার এক প্রান্তে চৌকির ওপর বসে একটি ছেলে পাঠ্য বইয়ে মনোযোগ দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বারান্দার অপর প্রান্তে কয়েকজন স্ত্রীলোক গল্প করছে আর তাদের চারপাশে কয়েকটি ছেলে মেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছে।
একজন মধ্যবয়স্ক লোক বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে করতে বললেন, "সোহেল একটু দোকান থেকে ঘুরে আয় তো বাবা।"
সোহেল একটু বিরক্ত হয়ে পড়া থামিয়ে তার বাবাকে বলল, "কেন, ছোট্টুকে দোকান পাঠাও না; ও তো সারাদিন খেলেই বেড়াচ্ছে!"
ছোট্টু সোহেলের ছোট ভাই। পারিবারিক বিষয়ের হিসাব নিকাশ করার বয়স তার এখনো হয়নি। বাড়িটি বেড়া দেওয়ার জন্য কয়েকজন মজুর কাজ করছিল; এই জন্য কিছু দরকারী জিনিসের প্রয়োজন ছিল।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, "সে কিরে! ও কি এতগুলো জিনিস ঠিকমত আনতে পারবে? কাজগুলো আগে করে নে, তারপর না হয় পরে পড়তে বসিস।"
সোহেল রাগে বিড়বিড় করে বলতে বলতে উঠে গেল, "এখন পড়বো না, তখন পড়বো না, তো পড়বো কখন? এমনিতেই পড়াশোনার কোন জায়গা নেই। তার ওপর পড়তে বসলে কারো আর সহ্য হয় না। আমি সব করবো তো মিস্ত্রি গুলো করবে কি?"
প্রকৃতই, বন্যার পর থেকে সোহেলের পড়তে বসার সময়ই হয়ে ওঠেনি। বিশৃংখল সংসার কে সাজিয়ে তুলতে তাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। সোহেলের বিড়বিড় শব্দ তার বাবা মন্টু বাবুর কানে পৌঁছালেও তিনি কোন উত্তর করলেন না। একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নিঃশব্দে বেড়া মেরামতির কাজে মনোযোগ দিলেন। সোহেল দোকান থেকে ফিরে এলে তাকে মজুরদের সঙ্গে ছোটখাটো কাজে যোগদান করতে হলো। সুতরাং তার সেদিনের পড়াগুলো ভবিষ্যতের বোঝা স্বরূপ সঞ্চিত রইল।
(৩)
বারান্দায়, চৌকির উপর বসে সোহেল বইটিকে সামনে নিয়ে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সাদা পৃষ্ঠার লেখাগুলো তার হৃদয়ে বিন্দুমাত্র ছাপ ফেলতে পারেনি। বারান্দায় বসে তখন তার মা তার বাবার সামনে বলে চলেছেন, "ওরা আমার মেয়েকে এখন পর্যন্ত দেখতে এলো না; আঁতুরে ছেলেটার মুখটা পর্যন্ত তারা দেখল না।....... ওরা যদি আর কোনদিন না আসে তাহলে আমার মেয়েটার কি হবে গো..... তুমি না হয় ওদের বাড়ি একটু খোঁজ নিয়ে দেখো না....।" এই কথাগুলো যার জন্য বলা হচ্ছে সোহেলের সেই প্রিয় দিদি তখন ইটের ঘরটিতে তার সত্যজাত শিশুটিকে কোলে নিয়ে নিশ্চল হয়ে বসে আছে। কি একটা কারণে কয়েক মাস থেকে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে দিদির কোনো সম্পর্ক নেই। এই নিয়ে সংসারে নতুন এক অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
সোহেল সামনে বই রেখে তার দিদির কথা-ই চিন্তা করছিল। ভগ্নিপতির প্রতি নিষ্ফল ক্রোধে তার হৃদয়টি জ্বলে যাচ্ছিল। তীব্র আক্রোশ তার বাকশক্তি রোধ করে ফেলছিল।
"মন্টু ভাই বাড়িতে আছেন?" বাইরের এই একটি ডাক-ই বাড়ির সমস্ত কথাবার্তা মুহূর্তে স্তব্ধ করে দিল।
মন্টুবাবু নিচু স্বরে সোহেলকে বললেন, "বাইরে গিয়ে একটু বলে আয় তো যে, বাবা বাড়িতে নেই।"
সোহেল সরাসরি অস্বীকার করে বলল, "আমি বারবার ওদের ফেরত পাঠাতে পারব না; টাকা না পেলে ওরা আর কিচ্ছু শুনবে না। সেদিন ওরা যা ইচ্ছে তাই বলে গেল; আজ আমি যেতে পারব না।"
বারংবারের অমার্জিত ডাকে বাধ্য হয়ে মন্টু বাবু সাড়া দিয়ে বাইরে গেলেন।
প্রায় এক বছর পূর্বে মন্টু বাবু পাকা রাস্তার ধারে একখানি পাকা বাড়ি প্রস্তুত করাচ্ছিলেন। কিন্তু অর্থের অভাবে তা শেষ করতে পারেননি। সিমেন্ট বালি ধার করে কাজ চালালেও শেষ পর্যন্ত বাড়িটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সিমেন্ট বালির দোকানদারও সে সময় নির্দ্বিধায় ধার দিয়েছিল। বস্তুত মন্টু বাবু পারতোপক্ষে কাউকে কখনো ফাঁকি দিতেন না; যথাসম্ভব শীঘ্রই তিনি সবার পাওনা মিটিয়ে ফেলতেন। কিন্তু শেষে সিমেন্ট বালির দোকানদার তার পাওনা না পেয়ে মন্টু বাবুকে তাগাদা দিতে শুরু করে। আজ সেই দোকানদার সহ আর একজন পাওনাদার তার বাড়িতে হানা দিতে এসেছে।
কোন রকম ভূমিকা না করেই পাওনাদার বলল, "আমাদের টাকাটা মিটিয়ে দিন।"
"দেখুন টাকাটা এখনো আমি যোগাড় করে উঠতে পারিনি। আমার হাতে এখন মোটেও কিছু নেই। আপনার না হয় আর কিছুদিন.........."
পাওনাদার তার গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে বলতে শুরু করল, "আমরা আপনার ওসব কথা তো শুনতে আসিনি! এক মাসের মধ্যে টাকা দেওয়ার কথা ছিল। বছর পার হতে চলল; এখনো টাকা দেওয়ার কোন নাম গন্ধ নেই....... আজ টাকা না পেলে আমরা এক পা-ও নড়ছি না...."
এদের উত্তেজিত কথাবার্তায় ক্রমে আশেপাশে লোক জমতে শুরু করল। মন্টু বাবু অনুনয়ের সুরে পাওনাদারদের নিরস্ত হতে বললেন এবং ওয়াদা করলেন যে আগামী মাসের মধ্যে যে করেই হোক না কেন তিনি তাদের বাকি টাকা সুদসহ মিটিয়ে দেবেন।
পাওনাদার চলে গেলে সোহেল তার বাবাকে বললো, "তুমি আজ-ই রাস্তার পাশের জমিটা বিক্রি করে ওদের টাকা মিটিয়ে দিয়ে এসো।"
সোহেলের কথার কোন উত্তর না দিয়ে তার বাবা বারান্দায় এসে ধপ করে বসে পড়লেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের সামনে অপমানিত হয়ে যেন এ লোকটি তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সোহেল টাকা মিটিয়ে দেওয়ার নানা প্রকার বাস্তব-অবাস্তব উপায় তার বাবার সামনে বলে চলল। কিন্তু তার বাবার তরফ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে সে অন্যত্র চলে গেল।
সারাটি দিন সে অবাস্তব কল্প-লোকের স্বর্ণময় রাজ্যে অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত থাকলো। কিভাবে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মত কোন বস্তু থেকে হঠাৎ সে বিরাট অংকের টাকা পেয়ে যাবে এবং সেগুলো কিভাবে পাওনাদারদের সামনে গিয়ে ছুঁড়ে মারবে, এ চিন্তাতেই সে সারাদিন বিভোর হয়ে থাকল। অবশেষে বিকেল বেলা সে সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় পাড়ার শিক্ষিত অশিক্ষিত ছেলেগুলি খেলার মাঠে এসে আড্ডা জমাত। তাদের সারাদিনের কুকর্ম সুকর্মের একটা মুখরোচক ইতিহাস সত্য মিথ্যায় জড়িয়ে এখানে পরিবেশন করা হতো, এবং তা রাত্রি নয়টা দশটা পর্যন্ত নানা বাদ-প্রতিবাদ, তর্ক-বিতর্কের সম্মুখীন হয়ে স্তব্ধ হয়ে যেত। সোহেল সমস্ত বিকেল বেলা উদভ্রান্তের মত এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে এই আড্ডাখানায় উপস্থিত হলো।
তাকে হঠাৎ সন্ধ্যাবেলায় তাদের কাছে বসতে দেখে একজন একটু অবাক হয়ে বলল, "তুই আবার আমাদের দলে মিশতে এলি কেন রে? অন্য দিন তো ডেকেও তোর পাত্তা পাওয়া যায় না!"
বস্তুত এই ছোকরাদের দলে সোহেলকে কদাচিৎ দেখা যেত - বিশেষত সন্ধ্যার পর তাকে পড়ার ঘর ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যেত না।
সোহেল এদের কথার কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে পড়ল। এই ছেলেদের মধ্যে তখন একজন সিগারেট ধরাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সোহেল তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, "আমাকে একটা সিগারেট দে তো বাপি।"
ছেলেরা প্রত্যেকেই অবাক হয়ে সমস্বরে যেন আর্তনাদ করে উঠল, "অ্যাঁ, তুই সিগারেট খাবি?" সোহেল প্রায় ছোঁ মেরে বাপির হাত থেকে একটা সিগারেট কেড়ে নিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে আটকে তাতে আগুন জ্বালিয়ে টানতে শুরু করল। এর অস্বাভাবিক আচরণে প্রত্যেকে হতভম্ব হয়ে গেল। বাপি তার বিহ্বল ভাব কাটিয়ে বলে উঠলো, "ওভাবে সিগারেট টেনে কখনো ইন্টারেস্ট পাওয়া যায়? এই দেখ আমি কিভাবে টানি।"
বাপি তার সিগারেট ধরিয়ে 'ইন্টারেস্ট' কিভাবে পাওয়া যায় তার বিভিন্ন কৌশল প্রদর্শন করতে শুরু করল। অনভিজ্ঞ সোহেল তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে বার কয়েক কেশে উঠলো। এভাবেই আড্ডাবাজদের কাছ থেকে সময় অপচয়ের বিভিন্ন পন্থা আয়ত্ত করে সে রাত্রি দশটায় বাড়ি ফিরল।
এরপর থেকে তাকে প্রায়ই এই মজলিসে দেখা যেতে শুরু করল। বাড়ির জটিল পরিস্থিতির ছোবল থেকে নিজের মনকে মুক্ত রাখার জন্য এক সময় সে নিজেকে এই মাহফিলের একজন নিয়মিত সদস্য হিসেবে গড়ে তুলল।
(৪)
মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। সোহেলদের স্কুলে পনের জন স্টার এবং চল্লিশ জন ফার্স্ট ডিভিশন নিয়ে পাশ করেছে। রাজু জেলা স্তরে প্রথম অথবা দ্বিতীয় কি যেন একটা পজিশন পেয়ে স্কুলের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বরের অধিকারী হয়েছে। অথচ এই ছেলেটি এর আগে কোনদিনও সোহেলকে টপকে স্কুলে প্রথম স্থান অধিকার করতে পারেনি। সোহেল রেজাল্ট জেনে স্কুলের এক কোণে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কোন রকমে ফার্স্ট ডিভিশনটা পেয়েছে। তার চোখের সামনে তখন অনেকেই রাজুকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিয়েছে। স্টার বয় গুলোর অনেকেই যে এর থেকেও ভালো রেজাল্ট করতে পারত, কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তার একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা পরস্পরকে প্রদান করে চলেছে।
এদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠল - নিজেকে মনে হতে লাগলো যেন পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ব্যর্থ জীব। সে দ্রুত স্কুলের পাশের আম বাগানে গিয়ে বসে পড়ল। সামনে মাঠের শস্য গুলিকে নিয়ে তখন স্নিগ্ধ বাতাস খেলা করছিল। এই নিস্তব্ধ শান্ত ক্রীড়াচ্ছল প্রকৃতির মধ্যে এসে সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না - হাতের উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এক অদৃশ্য সত্ত্বার প্রতি তীব্র অভিমানে তার হৃদয় খানা গুমরে গুমরে উঠছিল; অসহিষ্ণু হৃদয় বার বার সেই সর্বশক্তিমানের উদ্দেশ্যে এ প্রশ্নই করতে লাগলো - প্রভু গো, আমি তো তোমার কাছে রেজাল্টের জন্য প্রার্থনা করেছিলাম, অথচ তার পরিবর্তে তুমি আমায় এই শাস্তি দিলে?
(৫)
রেজাল্টের কয়েকদিন পর থেকে ছাত্রদের মধ্যে নতুন ক্লাসে ভর্তির একটা ধুম পড়ে গেল। যে যার পছন্দ মতো স্কুল বা মিশন নির্বাচন করে ভর্তির ফরম নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। মন্টু বাবুও নিকটবর্তী এক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ছেলেকে প্রায় জোর করে ভর্তি করিয়ে দিলেন এবং প্রয়োজনীয় বই পত্র কিনে দিলেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়ির সকলে জেনে গেল যে মন্টু বাবু সুদে টাকা ধার নিয়ে বইপত্র কেনা সহ অন্যান্য খরচ চালিয়েছেন। এতে তীব্র আপত্তি জানিয়ে সোহেল পড়াশোনা করতে অস্বীকার করে বসলো।
ঐদিন বিকেলবেলাতেই সে তার বন্ধু বিকাশের বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। বিকাশ বোম্বের কোন এক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে। বাড়িতে বেশ কিছুদিন কাটাবার পর আগামী কাল আবার সে বোম্বে রওনা হবে। সোহেল তার সঙ্গে বোম্বে কাজ করতে যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল।
বাড়ি ফেরার পথে সোহেল তার স্কুলের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। সন্ধ্যার আবছা আলোকে তখন নির্জন স্কুলটি এক অদ্ভুত রুপ ধারণ করেছে। সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের বিদায় জানিয়ে নিস্তব্ধ প্রকৃতির মধ্যে যেন সে তার বুকে ঘটে যাওয়া সমস্ত দিনের ঘটনাবলীর একটা গুরুত্বপূর্ণ হিসাব নিয়ে ব্যস্ত আছে। এই স্মৃতিবহুল বিদ্যালয়টি আজ যেন হঠাৎ সোহেলের সামনে তার নিজস্বতা প্রকাশ করে দিল - নির্নিমেষ চোখে সে স্কুলটির দিকে চেয়ে রইল। ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো তার ফার্স্ট বয় জীবনের স্বপ্নময় মুহূর্তগুলি -- সামনের এই প্রাঙ্গনণেই একদিন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে হেড স্যার তাকে নিয়ে যে গর্ব প্রকাশ করেছিলেন এবং দর্শকমণ্ডলীর সম্মিলিত হাততালির মধ্য দিয়ে তাকে যে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছিল আজ হঠাৎ সেই স্মৃতিগুলি সহস্র বেদনার ভার নিয়ে তার হৃদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। সামনের এই ক্লাসরুমেই সে তার বন্ধুদের সামনে গর্ব করে তার ভবিষ্যৎ জীবনে ডাক্তার হওয়ার পরিকল্পনা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছিল....... আজ সেই পরিকল্পনাটি তীব্র ব্যঙ্গ এবং পরিহাস নিয়ে তার সামনে অবতীর্ণ হল।
ধীরে ধীরে অতীতের এক একটি কাহিনী তার চোখের জলে ভেসে উঠলো আর পরক্ষণেই তা অশ্রু বিন্দুতে পরিণত হয়ে ধরাতলে অদৃশ্য হয়ে গেল। এই ভাবে যে স্কুলের দিকে তাকিয়ে সে কতক্ষণ কাটিয়ে দিল তা তার খেয়াল ছিল না। হঠাৎ পেছনের একটি ডাকে সে সম্বিত ফিরে পেল, "কিরে, তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? বাড়ি গিয়ে জামা কাপড় গোছাবি কখন?"
পিছন ফিরে সে তাকিয়ে দেখে বিকাশ সাইকেল নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সোহেল দ্রুত তার চোখের জল মুছে আমতা আমতা করে বলল, "এই যে এক্ষুনি...... এই যে এক্ষুনি........" বলতে বলতেই সাইকেলে চেপে সে বাড়ির পথে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সমাপ্ত